পোতাজিয়া নবরত্ন মন্দিরঃ
শাহজাদপুর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পোতাজিয়া নামক গ্রামে পোতাজিয়া নবরত্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। বর্গাকারে নির্মিত এই মন্দিরের প্রত্যেক বাহু ছিল ৯.০৯মিটার। দোলমঞ্চ আকারে নির্মিত মন্দিরটি তিনতলা বিশিষ্ট ছিল। প্রথম তলের চারকোণে ৪টি, দ্বিতীয় তলের চারকোণে ৪টি এবং তৃতীয় তলের উপরে ১টি মোট ৯টি চূড়া বা রত্ন ছিল বলে এ’টি নবরত্ন মন্দির নামে পরিচিত। বর্তমানে মন্দিরের চূড়া বা রত্নগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত।
মন্দিরের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব কর্ণারে প্রায় ৬মিটার উঁচু দু’টি দেয়াল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। চুন সুরকী ও পাতলা ইট দ্বারা নির্মিত দেয়ালে পোড়ামাটির চিত্রফলক লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে মন্দিরের আশেপাশে বেশ কিছু ঘরবাড়ী নির্মিত হয়েছে। মন্দিরটিরধ্বংসাবশেষ দেখে ধারণা হয় এ’টি সপ্তদশ শতকে নির্মিত। বৃহত্তর পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক রাধারমন শাহা এর মতে ১৭০০ সালে বঙ্গীয় কায়স্থ সমাজের পক্ষে গোবিন্দ রাম কৃষ্ণবল্লব রায় এ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন ।
হাটিকুমরুল গ্রামের মন্দির সমূহঃ
সিরাজগঞ্জ মোড় থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে উল্লাপাড়া-বগুড়া মহাসড়কের ১কিলোমিটার পূর্বদিকে হাটিকুমরুল গ্রামে ১টি নবরত্ন মন্দির, ২টি শিবমন্দির এবং ১টি দোচালা আকৃতির মন্দির আছে।
নবরত্ন মন্দিরঃ
হাটিকুমরুল গ্রামে অবস্থিত সবচেয়ে বড় মন্দিরটি দোলমঞ্চ বা নবরত্ন মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের উপরের রত্ন বা চূড়াগুলোর অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। দিনাজপুর জেলার কান্তনগর মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত দ্বিতল বিশিষ্ট এ মন্দিরের আয়তন ১৭মিটার ঢ ১৭মিটার। মন্দিরের চারদিকে টানা বারান্দা বেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ রয়েছে। বারান্দার বাইরের দিকে ৭টি এবং ভিতরের দিকে ৫টি খিলান প্রবেশপথ আছে। দ্বিতীয় তলায় বারান্দা নেই। দেয়াল ও স্তম্ভগুলোর উপরে অতি সুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক ছিল। বেশিরভাগ চিত্রফলকে ফুল ও লতাপাতার কাজ ছিল। চিত্রফলকগুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেলেও কিছু কিছু ফলকচিত্র এখনও টিকে আছে। মন্দিরের ১ম ও ২য় তলায় ছাদের চারকোণে চারটি করে ৮(আট)টি এবং সর্বশেষ স্তরের উপর ১টি মোট ৯টি চূড়া বা রত্ন ছিল। তাই এটি নবরত্ন মন্দির নামে পরিচিত। রত্ন বা চূড়াগুলো ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছু কিছু নিদর্শন এখনও বিদ্যমান। মন্দিরের ছাদ প্রান্ত আংশিক বাঁকানো।
এ মন্দিরে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে কিছু পাঠ্যজাত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, নবাব মুর্শিদকুলী খানের শাসনামলে রামনাথ ভাদুড়ী নামে জনৈক তহসীলদার খ্রিঃ ১৭০৪-১৭২৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ'টি নির্মাণ করেছিলেন ।
মন্দির সংলগ্ন পশ্চিম দিকে একটি মজে যাওয়া ছোট পুকুর আছে। স্থানীয় জনপ্রবাদ মতে পুকুরে নাকি লোহার সিন্দুক রয়েছে এবং সেই সিন্দুক মন্দিরের তলদেশ থেকে লোহার শিকলে আবদ্ধ।
বড় শিবমন্দিরঃ
নবরত্ন মন্দির থেকে প্রায় ১৩০ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটা মজা পুকুরের পূর্ব পাশে মন্দিরটি অবস্থিত। বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের প্রতিটি বাহু ৫মিটার এবং পূর্ব বাহুতে একটি মাত্র প্রবেশপথ আছে।
প্রবেশপথের উভয় পাশে ও উপরে চমৎকার পোড়ামাটির চিত্রফলক রয়েছে। উপরের চিত্রফলকগুলো কিছু খোয়া গেলেও দু’পাশে এখনও বহু চিত্রফলক মন্দিরের শোভাবর্ধন করছে। মন্দিরটি রত্ন বা চূড়া আকৃতির ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং বেশ উঁচু। এ মন্দিরেও কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি, তবে নির্মাণ শৈলীর বিচারে মন্দিরটি নবরত্ন মন্দিরের সমসাময়িক অর্থাৎ খ্রিঃ ১৭ শতকে নির্মিত বলে ধারণা করা য়ায় ।
ছোট শিবমন্দিরঃ
নবরত্ন মন্দিরের ২০ মিটার উত্তর-পূর্ব পাশে ছোট আকৃতির একটি মন্দির আছে। বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের প্রতিটি বাহু ৩ মিটার। দক্ষিণ বাহুতে একটি মাত্র প্রবেশপথ রয়েছে।
চুন সুরকী ও পাতলা ইট দ্বারা নির্মিত মন্দিরের ছাদ চূড়া আকৃতির এবং সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৮মিটার উঁচু। এ মন্দিরে পোড়ামাটির চিত্রফলক লক্ষ্য করা যায় না । মন্দিরটি খ্রি. ১৭ শতকে নির্মিত বলে ধারণা করা যায়।
দোচালা মন্দিরঃ
নবরত্ন মন্দিরের আনুমানিক ৫০ মিটার উত্তরে প্রায় ৬ মিটার ঢ ৪ মিটার পরিমাপের আয়তাকার একটি বিচিত্র মন্দির রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ মন্দিরের উপরে দোচালা ঘরের আকৃতিতে নির্মিত পাকা ছাদ আছে। বাঁকানো কার্ণিশ বিশিষ্ট এ মন্দিরটি দেখতে বড়ই সুন্দর।
এ মন্দিরের গায়ে কোন কারুকার্য বা পোড়ামাটির চিত্রফলক নেই। মন্দিরে পূর্ব দেয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে একটি মাত্র প্রবেশ পথ আছে। মন্দিরটি চুন সুরকী ও পাতলা ইট দ্বারা নির্মিত এবং দেয়ালে চুন সুরকীর আস্তর রয়েছে। হাটিকুমরুল গ্রামে অবস্থিত অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় এ'টি বেশ অটুট অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মতে অন্তপুরের মহিলাদের পূজা অর্চনার নিমিত্তে এ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। এ মন্দিরের অদূরে পশ্চিম পাশে প্রাচীন ইটের ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্য করা যায়। এ ধ্বংসাবশেষটি মন্দির নির্মাতার আবাস বাটি/বাড়ি বলে অনেকে মনে করেন। এ মন্দিরের কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে গঠণ প্রণালী ও স্থাপত্য শৈলীর আলোকে অনুমিত হয় যে, এটি উনবিংশ শতকের শেষভাগে নির্মিত হয়েছিল।
বিরাট রাজার বাড়ীঃ
বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানায় অবস্থিত নিমগাছী একটি অতিপ্রাচীন স্থান। নিমগাছী গ্রামকে কেন্দ্র করে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে প্রায় ১২ কিলোমিটার ব্যাপী অসংখ্য প্রাচীনকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এ স্থানকে মহাভারতে বর্ণিত মৎস্য দেশের বিরাট রাজার রাজধানী বলে জনপ্রবাদ মতে অভিহিত করা হয়ে থাকে এবং সেই সুত্রে এ স্থানের অপর নাম বিরাট শহর।
নিমগাছী গ্রামের পূর্বদিক দিয়ে একটি প্রাচীন ও সুবৃহৎ নদীর খাদ দেখা যায়। এ খাদ ভরাট হয়ে বর্তমানে চাষের জমিতে পরিনত হয়েছে। এটি ছিল তৎকালীন বিখ্যাত করতোয়া নদীর শাখা। করতোয়া নদীর ডান তীরেই প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল নিমগাছীর বিরাট জনপদ। হাট এলাকাকে স্থানীয় মানুষ নিমশহর বলে থাকেন। নিমগাছী গ্রামে বড় বড় বেশ কয়েকটি দীঘি আছে। এগুলোর মধ্যে জয়সাগর দীঘিটি আকারে সবচেয়ে বড়। নিমশহরে একটি উল্লেখযোগ্য মাজার আছে। এ গ্রামের সবচেয়ে বড় ঢিবিটিকে মহাভারতে বর্ণিত মৎস্য দেশের রাজা বিরাটের রাজপ্রাসাদ বলে চিহ্নিত করা যায়। রাজবাড়ী ঢিবিতে ৩টি গুপ্ত আমলের পোড়ামাটির চিত্রফলক পাওয়া যায়। তাছাড়া এখানে গুপ্ত আমালের একটি মুদ্রা প্রাপ্তির বিষয়ও জানা যায়। ১টি মুদ্রা ও ৩টি পোড়ামাটির ফলকচিত্র ও সারা অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষগুলো দেখেই এ স্থানের সময়কাল নির্ধারণ করা সম্ভবপর নহে। তবে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলো খুব সম্ভব গুপ্ত বা পাল আমলের বলে ধারণা করা যায়। গুপ্ত আমলের শেষ এবং পাল শাসনামলের প্রথম দিকে প্রাচীন করতোয়া নদীর তীরে একটি অতি সমৃদ্ধশালী জনপদের অস্তিত্ব ছিল। এখানে প্রায় ৫০টি ছোট বড় ঢিবির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে লুকায়িত আছে মন্দির ও আবাসস্থলের ধ্বংসাবশেষ। গুপ্ত যুগে এ জনপদের পত্তন হলেও পাল আমল পর্যন্ত এটি গৌরবের সঙ্গেই টিকে ছিল। এরপর করতোয়া নদী মরে যাওয়ার ফলে এ স্থানের প্রাধান্য কমে যায় এবং এ স্থানটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ফলে কালের বিবর্তনে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে মাটি চাপাপড়ে ঢিবিতে পরিণত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও উৎখনন পরিচালিত হলে এ স্থানের সঠিক ইতিহাস উৎঘাটন করা সম্ভব হবে বলে আসা করা যায়।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS