বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। হস্ত চালিত তাঁতে বছরে প্রায় ৭০ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয় যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ মিটিয়ে থাকে। এ শিল্প থেকে মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ প্রায় ১৫০০.০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের হস্ত চালিত তাঁত শিল্প এদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। সরকার কর্তৃক সম্পাদিত তাঁত শুমারী ২০০৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ লক্ষাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলাতে রয়েছে ১ লক্ষ ৩৫ হাজারের অধিক। মহিলাদের অংশগ্রহণ সহ গ্রামীণ কর্মসংস্থানের দিক থেকে এর স্থান কৃষির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ লোক পেশার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত।
সিরাজগঞ্জ দেশের অন্যতম তাঁত অধ্যূষিত এলাকা। এ জেলা তাঁত বস্ত্র উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত। সিরাজগঞ্জ জেলার সাথে তাঁতের নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সিরাজগঞ্জ জেলায় তাঁতী পরিবারের সংখ্যা মোট ১৪,৮৭০ এবং তাঁত সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতিবছর এ জেলায় হস্ত চালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়া এ শিল্প সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ৩ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁতীরা শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, থান কাপড়, থ্রি পিচ, গ্রামীণ চেক সহ বিভিন্ন প্রকার বস্ত্র উৎপাদন করে থাকে।
সিরাজগঞ্জ জেলার উপজেলাওয়ারী তাঁত ও তাঁতী সংখ্যা
ক্রম | উপজেলার নাম | তাঁতী পরিবার | চালু তাঁত সংখ্যা | বন্ধ তাঁত সংখ্যা | মোট তাঁত সংখ্যা |
০১ | সিরাজগঞ্জ সদর | ১,৯৯৭ | ১১,৫৩৮ | ৪,৩৭৮ | ১৫,৯১৬ |
০২ | বেলকুচি | ৩,৫১২ | ২৫,১৯৫ | ১৪,৪১৯ | ৩৯,৬১৪ |
০৩ | কামারখন্দ | ৫৫৭ | ৩,১৯২ | ২৩৮ | ৩,৪৩০ |
০৪ | কাজিপুর | ২২৫ | ১,৩৪৪ | ৩৩৫ | ১,৬৭৯ |
০৫ | তাড়াশ | ০৩ | ০৮ | ০১ | ০৯ |
০৬ | শাহজাদপুর | ৪,৯৬১ | ৩৪,৬৪৪ | ১৩,১৯৫ | ৪৭,৮৩৯ |
০৭ | চৌহালী | ৬২৯ | ৩,৯৯১ | ২,৪৯১ | ৬,৪৮২ |
০৮ | উল্লাপাড়া | ১,৮৮৬ | ১১,০৫৭ | ৩,৭৮৮ | ১৪,৮৪৫ |
০৯ | রায়গঞ্জ | ৮৫৫ | ৩,৯৮৮ | ১,৫৯৩ | ৫,৫৮১ |
| মোট = | ১৪,৬২৫ | ৯৪,৯৫৭ | ৪০,৪৩৮ | ১,৩৫,৩৯৫ |
দেশের অন্যান্য জেলার মতো সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁত শিল্পে নিয়োজিত অধিকাংশ লোক পল্লী এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের প্রচলিত ব্যবস্থা এখনও অত্যন্ত অসংগঠিত। জেলার কয়েকটি হাটে তাঁতীদের উৎপাদিত বস্ত্র বিক্রি হয়ে থাকে যার মধ্যে সোহাগপুর হাট, শাহাপুর হাট, এনায়েতপুর হাট ও সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেট হাট উল্লেখযোগ্য । বিদ্যমান বিপণন ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্ত্বভোগী মহাজন, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা তাঁতীদের নিকট থেকে বস্ত্র ক্রয় করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁত বস্ত্র বিপণনের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা দরকার। তাঁতীরাও প্রত্যাশা করে তাদের উৎপাদিত তাঁত বস্ত্র বিক্রয় ও রপ্তানির মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের উন্নয়নসহ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। কিন্তু অবেহলিত তাঁতীদের সেই আশা অপূর্ণ থেকে যায়। ক্রমাগত সুতার মূল্য বৃদ্ধি, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধি এবং তাদের উৎপাদিত বস্ত্র সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের সমস্যার কারণে তাঁতীরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তারা ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। ফলে আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়েছে। তাই অনেকে তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পৌরসভার আওতাধীন অনেক এলাকারই অনেক তাঁতী এখন অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁত শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও এ শিল্পের সমস্যা অনেক। তাঁতীদের সুষ্ঠু সংগঠনের অভাব, মূলধনের অভাব, ন্যায্য মূল্যে মানসম্পন্ন উৎপাদন উপকরণ সহজলভ্য না হওয়া, প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাব, উৎপাদিত বস্ত্রের সুষ্ঠু বিপণনের অভাব প্রভৃতি তাঁত শিল্পের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে।সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁত শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও তাঁতীদের কল্যাণার্থে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তিনটি বেসিক সেন্টার এ জেলায় রয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, কামারখন্দ, কাজিপুর ও তাড়াশ উপজেলা নিয়ে বেসিক সেন্টার সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলা নিয়ে বেসিক সেন্টার শাহজাদপুর এবং উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলা নিয়ে বেসিক সেন্টার উল্লাপাড়া কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখিত ৩টি বেসিক সেন্টার হতে তাঁতীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী প্রকল্পের আওতায় ৩,৮৫০ জন তাঁতীর মধ্যে ৬ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। উক্ত ঋণ কার্যক্রম ১৯৯৯ সালে শুরু হয়ে অদ্যাবধি চলমান রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কাস্টমস হাউসে রক্ষিত সুতা স্বল্প মূল্যে বিভিন্ন তাঁতী সমিতিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। তাঁতীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নরসিংদী তাঁত প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও পাবনা জেলার বেড়াতে তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড উক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহে তাঁতীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এছাড়া পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে বেনারসী পল্লী স্থাপন করা হয়েছে যেখানে সিরাজগঞ্জ জেলার অনেক তাঁতী রয়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ বিশেষ করে বন্যার সময় বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড তিনটি বেসিক সেন্টারের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁতীদের আর্থিক অনুদান দিয়ে দূর্যোগকালীণ সময়ে সহায়তা করে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বিভিন্ন তাঁতী সমিতি গঠনের মাধ্যমে তাঁতীদের সুসংগঠিত করে থাকে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস